জনতার খবর রিপোর্টার
প্রকাশঃ 27-অক্টোবর-2025 ইং
অনলাইন সংস্করণ

অনলাইন জুয়া: ক্ষণিকের আনন্দে হারিয়ে যাচ্ছে এক প্রজন্ম

সাকিল আহমেদ
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগ। মানুষের হাতের মুঠোয় এখন পুরো পৃথিবী। কিন্তু এই প্রযুক্তির অপব্যবহারও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হলো অনলাইন জুয়া। সহজ ইন্টারনেট সংযোগ এবং স্মার্টফোনের প্রাপ্যতার কারণে তরুণ সমাজ এখন এই ভয়ংকর আসক্তিতে দ্রুত জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য বিনোদনের আশায় শুরু হওয়া এই অনলাইন জুয়া শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছে তাদের অর্থ, সময়, মানসিক শান্তি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

একসময় জুয়া মানে ছিল নির্দিষ্ট স্থানে বসে খেলা— তাস, পাশা বা বোর্ডের মাধ্যমে। কিন্তু এখন আর তা নয়। ঘরে বসে কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমেই মানুষ প্রবেশ করছে ভার্চুয়াল জুয়ার জগতে। প্রথমে হয়তো এটি বিনোদন হিসেবে শুরু হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় ভয়াবহ নেশায়। প্রতিদিনই অনেকে নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে এই অন্ধকার জগতে, যার ফলাফল প্রায়ই ধ্বংসাত্মক।

অনলাইন জুয়া মূলত দ্রুত অর্থলাভের প্রলোভন দেখায়। “মাত্র একবার জিতলেই ভাগ্য ঘুরে যাবে”— এই বিশ্বাসে অনেকে ঢুকে পড়ে জুয়ার ফাঁদে। শুরুতে সামান্য লাভ পেলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষতির অঙ্কটাই বেড়ে যায় বহুগুণে। একজন অনলাইন জুয়াড়ি যত বেশি হারতে থাকে, ততই হারানো টাকা পুষিয়ে নিতে আবার খেলার প্রবণতা জন্মায়। আর এই চক্রই তাকে গভীর অন্ধকারে টেনে নেয়। কেউ কেউ পরিবারের কাছ থেকে গোপনে টাকা নেয়, কেউ বিক্রি করে ব্যক্তিগত সম্পদ, আবার কেউ ঋণের বোঝা কাঁধে তুলে নেয়।

এই আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি অনলাইন জুয়া ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত হারার হতাশা থেকে জন্ম নেয় মানসিক চাপ, উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা ও বিষণ্নতা। অনেক ক্ষেত্রে তা আত্মহননের মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্তের দিকেও ঠেলে দেয় মানুষকে। চিকিৎসকদের মতে, অনলাইন জুয়া একধরনের আচরণগত আসক্তি— যা মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। কারণ জেতার সময় যে উত্তেজনা তৈরি হয়, তা মস্তিষ্কে একধরনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, যা পরবর্তী সময়ে আবার জেতার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে।

একজন অনলাইন জুয়াড়ির জীবন হয়ে পড়ে অগোছালো। পরিবারে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়, বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কর্মজীবনে মনোযোগ কমে যায়, শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলে তাদের পড়াশোনার আগ্রহ। ফলে সমাজের এক বিশাল অংশ ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে মানসিকভাবে অস্থির এক প্রজন্মে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে বড় অংশই তরুণ। তারা বিনোদনের নামে নানারকম অনলাইন গেম, স্পোর্টস বেটিং বা লটারি সাইটে প্রবেশ করছে। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে জুয়া ব্যবসার বিশাল জাল। এইসব সাইট ও অ্যাপগুলো এমনভাবে তৈরি, যাতে ব্যবহারকারী ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। কেউ একবার জুয়ায় হারলে তাকে পুনরায় খেলায় ফেরানোর জন্য সাইটগুলো নানা অফার দেয়— যেমন বোনাস, ফ্রি কয়েন বা বাড়তি পয়েন্ট। ফলে একবার যিনি জড়িয়েছেন, তার পক্ষে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে জুয়া আইনত নিষিদ্ধ। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের জুয়া আয়োজন, অংশগ্রহণ বা প্রচারণা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলকভাবে কঠিন, কারণ অধিকাংশ সাইটই বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। এসব সাইটে টাকা লেনদেন হয় আন্তর্জাতিক অনলাইন পেমেন্ট মাধ্যমের মাধ্যমে, যা দেশীয় আইনের আওতায় সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবুও সরকার, বিটিআরসি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিতভাবে এসব সাইট বন্ধ এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

কিন্তু কেবল আইনি পদক্ষেপেই সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক দায়িত্ববোধ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা। শিক্ষকরা যদি শ্রেণিকক্ষে নৈতিক শিক্ষা ও আত্মসংযমের গুরুত্ব তুলে ধরেন, তবে তরুণদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিয়মিত প্রচারণার মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার কুফল তুলে ধরা জরুরি।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন জুয়া থেকে মুক্তির সবচেয়ে বড় উপায় হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ইতিবাচক কাজে মনোনিবেশ করা। খেলাধুলা, বই পড়া, সঙ্গীত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তরুণদের সঠিক পথে রাখে। যেসব তরুণ ইতিমধ্যে জুয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের প্রতি সমাজের সহানুভূতিশীল আচরণ প্রয়োজন। তাদের বঞ্চিত না করে পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফুল ইসলাম বলেন, “অনলাইন জুয়া এক ধরনের আচরণগত রোগ। এতে আসক্ত ব্যক্তি বারবার জেতার আশায় ঝুঁকি নিতে থাকে, যা তার মস্তিষ্কের ডোপামিন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে এটি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ জীবন নষ্ট করে দিতে পারে।”

বর্তমানে তরুণদের জন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, মানসিক প্রশিক্ষণ এবং সৃজনশীল কর্মে সম্পৃক্ততা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন সচেতনতামূলক প্রচারণা দরকার, তেমনি পরিবারিক পর্যায়েও দরকার আন্তরিক নজরদারি। একটি সমাজ তখনই উন্নত হয়, যখন তার তরুণ প্রজন্ম সৃজনশীল, ইতিবাচক ও দায়িত্ববান হয়ে ওঠে।

অতএব, অনলাইন জুয়া কোনো বিনোদন নয়— এটি এক নিঃশব্দ বিষ। এর শিকার হয় মানুষ, পরিবার, সমাজ, এমনকি পুরো জাতি। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এখনই সময় নিজেকে বদলানোর, ভবিষ্যৎকে রক্ষার।

অনলাইন জুয়া থেকে দূরে থাকা শুধু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বও। নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা, আত্মসংযম এবং সৎ পরিশ্রমই পারে এই আসক্তি থেকে মুক্তি দিতে।

বার্তা:
অনলাইন জুয়া ক্ষণিকের আনন্দ, কিন্তু ফল ভয়াবহ।
নিজেকে পাল্টাও, ভবিষ্যৎকে বাঁচাও।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এনটিআরসিএ নিয়োগ চক্রের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক শিক

1

সেনবাগে আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বিএনপির ৩১ দফা সম্বলিত লিফ

2

৩১ দফা বাস্তবায়নে সিলেটের টুকেরবাজারে বিএনপির প্রচার মিছিল

3

ভাঙ্গায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত

4

দিনাজপুর সদর আসনে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে

5

আমার নির্মাণে আমি

6

ঝালকাঠিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ইব্রাহিম আল হাদীর গণসংযো

7

নওগাঁ জেলার হাপানিয়া সীমান্তে মাদকসহ আটক-১

8

লংগদু সরকারি মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ

9

মাদ্রাসা শিক্ষকের বেদম প্রহারে শিক্ষার্থী গুরুত্বর অসুস্থ

10

পাঁচবিবিতে ২৮ অক্টোবর এর খুনীদের বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ মিছি

11

৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ রবিউলকে সাভার থেকে গ্রেফতার করে সাভার মড

12

বেনাপোলে নিখোঁজের দুই দিন পর ডোবায় মিলল যুবকের মরদেহ

13

ভাঙ্গুড়ায় বিদ্যালয়ে চৌকি, বিশ্রাম নেন প্রধান শিক্ষক ও তার

14

ছাতক উপজেলায় পাথর ব্যবসায়ীর মৃত্যু

15

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ

16

পটুয়াখালী মিথ্যা মামলা ও হয়রানির প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

17

যতক্ষণ মালিকপক্ষ হস্তক্ষেপ না করেন ততক্ষণ সংবাদমাধ্যম গুলো ম

18

শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ

19

পাবনায় করিমনের ধাক্কায় সাইকেল আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যু

20