একটা মানুষের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে প্রয়োজন : একটা দেহের অবয়ব বা অবকাঠামো, তার মধ্যে প্রয়োজন জীবন, আত্মা বা প্রাণ, এরপর জীবিত মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হইতে প্রয়োজন চেতনা, আর্দশ বা মনন চিন্তা।
ঠিক একইভাবে বাঙালি একটা পূর্ণাঙ্গ জাতির জাতি হিসেবে এই পৃথিবীর বুকে অস্বস্তি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - বাঙালির দেহের অবয়ব বা অবকাঠামো
কাজী নজরুল ইসলাম - বাঙালি জাতির জীবন, আত্মা বা প্রাণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - চেতনা, মনন চিন্তা বা স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নেওয়া
উপরিউক্ত তিন মহা মানব ছাড়া বাঙালি জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে বিলীন। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি পৃথিবীতে হাজারও আছে। কিন্তু তারা তাদের অস্বস্তি জানান দিতে পারে নাই। তারা নিজেদের জন্য একটা মুক্ত, স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে নাই। তাদের ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, কলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে নাই। যার কারণেই ব্রিটিশ, আমেরিকান, আরব, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আফ্রিকান, চাইনিজ, ভারতীয়, জাপানিজ, কোরিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান এমন কয়েকটি জাতিকে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে পৃথিবীতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দেখা যায়। এর বাইরেও যে হাজার হাজার জাতি বা গোত্রের মানুষ পৃথিবীতে বাস করছে তার কতটুকই জানি আমরা? এই যেমন ধরেন, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বালুচি, তামিল, তেলেগু, মারাঠি এমন হাজার হাজার জাতি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের পরিচিতি পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভবপর হয়নি। যারা মানব জাতিগোষ্ঠী নিয়ে পড়াশোনা করে বা গবেষণা করে তাদেরই কাছে তারা আংশিক পরিচিতি লাভ করেছে। অথচ, গৌরবের বিষয় হলো, বাঙালি জাতিকে গোটা পৃথিবীর মানুষ চেনে। কারণ, এই বাঙালি জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। তাছাড়া পৃথিবীতে এই একটি মাত্র জাতি যারা তাদের ভাষাগত জাতি গোত্রের জন্য রক্তের দামে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
আজ ২৪ মে, বাঙালি জাতির জীবন, প্রাণ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, লেখক, সংগীতজ্ঞ ও চিন্তাবিদ নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের এই দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা, গান ও গদ্যে শোষণ, বঞ্চনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছেন। তাঁর রচিত ‘বিদ্রোহী’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয়োল্লাস’ প্রভৃতি কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে রয়েছে।
নজরুল রচনা করেছেন চার হাজারেরও বেশি গান, যা “নজরুল সংগীত” নামে সমাদৃত। তাঁর গানে প্রেম, দ্রোহ, মানবতা ও সাম্যবাদের মেলবন্ধন দেখা যায়। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের পক্ষে জোরালোভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
১৯৪২ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং জীবনের শেষ তিন দশক প্রায় নিস্তব্ধতায় কাটে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে কবিকে নিয়ে আসা হয় এবং তাঁকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আজ সারাদেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ ও সাহিত্যকর্ম নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে – এমনটিই প্রত্যাশা দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে।
মন্তব্য করুন