শান্ত স্রোতের নদের বুকে দাঁড়িয়ে একটি সাঁকো। দুইটি লোহা ও চৌদ্দটি কংক্রিটের পিলারের ওপর কাঠের পাটাতন পেতে বানানো হয়েছে সেটি। পাটাতনের বহু জায়গা ভেঙে পড়েছে নদীগর্ভে, সেখানে তৈরি হওয়া ফাঁক দিয়ে জলের রেখা দেখা যাচ্ছে। সাঁকোর দুই পাশে নেই কোনো রেলিং, ভারি কিছু উঠলেই কেঁপে ওঠে কাঠের বুক। হাঁটার সময় কাঁপে পথচারীর বুক—এই বুঝি পাটাতন সরে গিয়ে পড়ে যেতে হবে নদের জলে।
ভাঙাচোরা এই সাঁকোর অবস্থান নড়াইল সদর উপজেলার আফরা ও যশোরের বসুন্দিয়া গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা বুড়ি ভৈরব নদের ওপর। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেতুর দুই পাশে বড় করে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘মোটরসাইকেল চালিয়ে, বোঝাই ভ্যান এবং ট্রলি ও নসিমন পারাপার নিষেধ।’ কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় কি থামে জীবনের গতি?
মোটরসাইকেল ঠেলে এক পার থেকে অন্যপারে যাচ্ছিলেন আফরা গ্রামের ইদ্রিস আলী। তিনি বললেন, সেতুর এমন অবস্থা- মোটরসাইকেল চালিয়ে আসা যায় না, ঠেলে আনতে হয়। উঠানো-নামানোতেও ঝুঁকি রয়েছে। একটা মোটরসাইকেল সেতুর ওপর থাকলে আরেকটা ওঠানো যায় না। দুইটা উঠালে নদীতে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ফলে একটা উঠলে, আরেকটাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুড়ি ভৈরব নদের পূর্ব পাশে নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের আটটি এবং পশ্চিমে যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়নের আটটি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের নানা প্রয়োজনে নদের একপার থেকে অন্যপারে যেতে হয়। একসময় নৌকা ছিল তাঁদের একমাত্র ভরসা। তবে এতে উভয় পারের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে নদীর পশ্চিম পারে যশোরের নওয়াপাড়া ও বসুন্দিয়ায় শিল্পকারখানায় কাজ করা পূর্ব পারের শ্রমিকদের ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হতো। এসব কথা চিন্তা করে ২০১২ সালে ওই নদের ওপর কাঠ ও বাঁশ দিয়ে প্রায় ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রশস্ত একটি সাঁকো নির্মাণ করেন এলাকাবাসী। এরপর তাঁরা বিভিন্ন সময় সাঁকোটির উন্নয়ন ও মেরামত করেছেন। তবে বর্তমানে এর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। তবুও প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই ভয়ে ভয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের এই সাঁকো পার হতে হয়।
সাঁকোর পশ্চিম পারের বাসিন্দা বৃদ্ধ আক্কাস আলী বলেন, একসময় নৌকায় এই নদ পার হতে হতো। পরে এই সাঁকো করা হয়। এখন প্রতিদিন দেড় হাজারের মত মানুষ এই সাঁকো পারাপার হয়। তবে চলাচলে ভোগান্তি অনেক।
সাঁকোর পূর্বপাশের জেলে জয়দেব বিশ্বাস বলেন, এই ভাঙাচোরা সাঁকো দিয়ে বোঝাই ভ্যান নিয়ে চলাচল করা যায় না। তাই ঝুঁকি নিয়ে মাথায় ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে ওপারে যায় বিক্রি করতে। সেতু থাকলে কষ্ট করা লাগত না, ভ্যানে করে নিয়ে যেতাম।
স্থানীয়দের দাবি, সাঁকো মেরামত করলে কিছুদিন পরপর তা নষ্ট হয়ে যায়। আর সাঁকো দিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের চলাচল অত্যন্ত কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষ হাঁটা গেলেও, বড় যানবাহন নিয়ে পার হওয়া যায় না। বৃষ্টির সময় সাঁকোর পাটাতন পিচ্ছিল হয়ে যায়, সংযোগ সড়কও কর্দমাক্ত থাকে, ফলে চলাচল ভোগান্তি আরো বাড়ে। তাই সাঁকো নয় এখানে প্রয়োজন একটি সেতুর। কিন্তু বারবার বিভিন্ন মহলে এ দাবি তুললেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
শেখহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, এই সাঁকোটি দিয়ে অনেক মানুষ চলাচল করে। এটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি সাঁকো। এখানে নতুন একটি সেতু হলে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এখানে একটি সেতু হওয়া খুবই প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে নড়াইল জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু বলেন, নড়াইল জেলার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ওখানে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। ডিজাইনের কাজ চলমান রয়েছে।###
মন্তব্য করুন