"যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে"
*কবি: পল্লী কবি জসিম উদ্দিন*
*বিশ্লেষণ: মোঃ মোস্তাক আহমদ*
বাংলা সাহিত্যে পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক নিসর্গ-ছোঁয়া বাংলাদেশ, যেখানে শ্যামলিমা আর আত্মার বন্ধন একে অপরকে জড়িয়ে আছে। তাঁর কবিতা "যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে"এই গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ভ্রাতৃত্ব, মমতা, মায়া ও প্রকৃতির স্নেহ মিশে আছে হৃদয়ের গভীর থেকে।
*মূলভাব:*
এই কবিতায় কবি তাঁর ভাইকে গ্রামের ঘরোয়া পরিবেশে আমন্ত্রণ জানান। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এক শান্ত, নিরিবিলি ছোট গ্রাম – যেখানে রয়েছে কচি নদী, বাঁধা নৌকা, নরম ঘাস, কলাবন, শালুক ফুল, এবং মায়ের মমতা, বোনের আদর, ভাইয়ের স্নেহ। কবি যেন শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন – যেখানে প্রতিটি দিন কেটেছে মাঠে ঢেলা কুড়িয়ে, খেলায় মেতে, আর প্রকৃতির সঙ্গে দোস্তি করে।
*প্রতিটি স্তবকের ব্যাখ্যা:*
*১ম স্তবক:*
কবি ভাইকে ডাকছেন — চল আমাদের ছোট গ্রামে। যেখানে গাছের ছায়া, পাতার লতা আর বনবাতাস এক ধরনের আবেগে জড়িয়ে রেখেছে তাঁর প্রিয় ঘরখানি। মা-বোন-ভাইয়ের ভালোবাসা সেখানে অপেক্ষা করছে।
*২য় স্তবক:*
ছোট নদীর কালো জল, বাঁধা তরী, আর বিনাসুতি মালার মতো দৃশ্য তুলে ধরে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও জীবনধারা। দুই পারে থাকা হৃদয়ের টান যেন গ্রামজুড়ে এক ভালবাসার জাল বুনে রেখেছে।
*৩য়-৪র্থ স্তবক:*
কলা বনের ঘিরে রাখা পথ যেন শহর থেকে আলাদা এক নিভৃত পরিবেশ। বুনো পাখি, মেঠো ফুল, তেলাকুচা লতা, সব মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবনকাব্য।
*৫ম-৬ষ্ঠ স্তবক:*
খেলাধুলা, রাখাল বন্ধুদের সাথে ইমারত গড়া, মটরের লতা থেকে সীম তুলে নেওয়া – সব কিছু যেন এক আনন্দ-ভরা শৈশবের প্রতিচ্ছবি। কবি বলেছেন, বাস্তব নগর ভুলে তারা এক "নকল নগর" গড়বে, যা তাদের নিজস্ব সৃষ্টি।
*৭ম-৮ম স্তবক:*
কবি শালুক ফুল দিয়ে মালা গাঁথবেন – এমন এক ফুলমালা যা কেহ কোনোদিন দেখেনি। আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার ভয় ও মাকে খুশি করার নানা কৌশল – এক শিশুসুলভ সহজ সত্য প্রকাশ পেয়েছে।
*৯ম-১০ম স্তবক:*
ভোরে উঠে মাছ ধরা, কাদামাটির সাথে খেলাধুলা করে বাড়ি ফেরা – এগুলো জীবনের আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতি। মার বকা আর ভালোবাসা মিশে একাকার হয়ে যায় যেন।
*শেষ স্তবকগুলো:*
তোমার সঙ্গে হারিয়ে যেতে চাই সেই ঘন বনছায়ায়, যেখানে আমার শৈশব লুকিয়ে ছিল। তুমি ফুল কুড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলো, আমি তোমার নাম ধরে খুঁজে ফিরি – এ যেন ভালোবাসা, বন্ধন, আর মায়ার কবিতা।
---
*উপসংহার:*
এই কবিতা শুধু একটি গ্রামের আহ্বান নয় — এটি শৈশবের, নিসর্গের, সম্পর্কের, এবং এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের প্রতিফলন। জসিম উদ্দিন তাঁর সরল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পাঠককে নিয়ে যান এমন এক গ্রামে, যেখানে জীবন ধীরে চলে, কিন্তু হৃদয়ের টান গভীর হয়।
---
তথ্যসূত্র:
১. জসিম উদ্দিন রচনাসমগ্র – বাংলা একাডেমি
২. বাংলা সাহিত্য কোষ – হারুন-উর-রশিদ
৩. "পল্লী কবি জসিম উদ্দিন: জীবন ও সাহিত্য" – গবেষণা প্রবন্ধ
৪. HSC বাংলা পাঠ্যবই।
মন্তব্য করুন