লক্ষণ কুমার মন্ডল
জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষকেও পরাজিত করে যে বিজয় মুকুট অর্জন করা যায়, তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা রায়। মৃত্যুঘাতী ব্লাড ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে তিনি শুধু বেঁচে ফিরে আসেননি, ছুঁয়ে ফেলেছেন নিজের বহু লালিত স্বপ্ন। ৪৫তম বিসিএসে কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডারে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই অদম্য নয়। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই প্রিয়াংকা ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বিভাগে একাধিক সেমিস্টারে নিখুঁত সিজিপিএ অর্থাৎ ৪ এর মধ্যে ৪ অর্জন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিভাগের সেরা। স্বপ্ন ছিল নিজের সাফল্য দিয়ে বাবাকে পরিচিত করা, ‘প্রিয়াংকার বাবা’ হিসেবে।
কিন্তু সবকিছু বদলে যায় ২০১৯ সালের ৩ জুলাই। ‘একিউট লিউকেমিয়া’ নামের নির্মম তথা মরণব্যাধি ক্যান্সার তার জীবনকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে শুরু হয় কঠিন চিকিৎসার পথ। সাধারণ স্কুলশিক্ষক বাবার পক্ষে চিকিৎসার বিশাল ব্যয় বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব, তবুও বাবা হাল ছাড়েননি, আর সহপাঠীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ছিল প্রিয়াংকার শক্তি হয়ে।
হাসপাতালের বিছানা থেকে যে মেয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, সেখান থেকেই সে শিখেছে—বেঁচে থাকা মানেই নতুন শুরু। চার মাসের তীব্র কষ্টকর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ফেরার পর তাঁর সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ছিল স্ট্যাডি গ্যাপের কারণে প্রাপ্য সম্মানগুলো না পাওয়া। এই আক্ষেপই তাকে আরও দৃঢ় করেছে।যেভাবেই হোক, তাকে সেরা হতেই হবে।
কোনো কোচিং ছাড়াই, শুধু নিজের প্রতিদিনের পরিশ্রম আর অবিচল বিশ্বাসের ওপর ভর করে তিনি শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। প্রিলিমিনারি, লিখিত—সব ধাপ পেরিয়ে, চাকরি করতে করতেই তিনি অংশ নেন ভাইভায়। বিসিএসের প্রস্তুতির মধ্যেই তিনি আবার সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান।
অবশেষে, সোনালী ব্যাংকে চাকুরীরত অবস্থায় গতকাল ৪৫তম বিসিএসের ফল যেদিন প্রকাশিত হলো, প্রিয়াংকা রায় নির্বাক হয়ে গেলেন। যে পরিবারের কাছে তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সেখানে ক্যাডার হওয়া যেন এক অতিরিক্ত অলৌকিক আনন্দ।
নিজের গল্প বলতে গিয়ে প্রিয়াংকা সংবাদ মাধ্যমে বলেন, “ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফিরেই বিশ্বাস হয়েছিল, আমি পারব। জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগকে আমার জেতার গল্পে পরিণত করতেই হয়েছিল।”
গৈরিক অভিনন্দন এবং শুভকামনা প্রিয়াংকা রায়কে। মাগুরার শালিখা থানার বুনাগাতি ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা প্রিয়াংকা আজ শুধু একজন বিসিএস ক্যাডার নন, তিনি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য জীবন্ত অনুপ্রেরণা।