পঞ্চাশ বছরের সংসার! পঞ্চাশ বছর একসঙ্গে থাকার পর কি দুজনের মধ্যে কিছু বলার থাকে? পুরোনো ঝুরঝুরে ভালোবাসার মধ্যেও কি কিছুটা বাকি থেকে যায় প্রকাশের? মাত্র একটা রাতের জন্য যদি নিজেদের পুরোনো সেদিন ফিরে আসে, তাহলে কেমন হতো? কী নিয়ে কথা বলত দুটি মানুষ?
এমন একটা গল্প পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরমব্রত চট্টপাধ্যায়। সিনেমার নাম ‘এই রাত তোমার আমার’। ৩১ জানুয়ারি সিনেমাটি হলে মুক্তি পেলেও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে এসেছে গত ২৮ মার্চ।
একনজরে
সিনেমা: ‘এই রাত তোমার আমার’
জনরা: ড্রামা
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: হইচই
কাহিনি ও চিত্রনাট্য: চিরঞ্জীব বরদোলই
পরিচালক: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়: অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রুতি দাস
ক্যানসারে আক্রান্ত জয়িতা। ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছেন। আর হাতে বেশি দিন নেই। একমাত্র ছেলে জয় ইংল্যান্ডে নিয়েও মাকে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে। কিন্তু কোনো আশা দিতে পারেননি ডাক্তার। জানিয়েছেন সেই একই কথা, ‘সময় বাঁধা।’ এদিকে ছেলে জয়ের সঙ্গে বনিবনা হয় না বাবা অমর গুপ্তর। তাঁর দৃষ্টিতে ছেলে বোঝে না মা-বাবার সেন্টিমেন্ট। কিন্তু ছেলেরও যে একটা নিজের জগৎ আছে, তা বুঝতে পারেন না বাবা। ভেবে বসেন, এ প্রজন্মের ছেলেরাই বুঝি এমন!
কলকাতা আসতে চান না অমর-জয়িতা কেউ–ই। তাই এখনো নিজেদের চা–বাগানের বাংলোতেই থাকেন তাঁরা। অমর একাই দেখাশোনা করেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী জয়িতার। বুড়োবুড়ির এই সংসারের প্রতি মায়াটা টের পাওয়া যায়, যখন একটি ইঁদুরও হয়ে যায় তাঁদের জীবনের অংশ।
রোগীর পথ্য খেয়ে, কেমোথেরাপি নিয়ে জয়িতা বড়ই ক্লান্ত। হসপিটাল যাওয়ার নাম শুনলেই ভয় হয় এখন তাঁর। জয়িতা রোগী হয়ে থাকতে চান না। এক রাতে তিনি হয়ে ওঠেন সেই আগের মতো—উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, আগের সেই তিনি। পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীতে সেজেগুজে বিছানা ছেড়ে উঠে অমরকে চমকে দেন তিনি। আর দুটি মানুষ পাশাপাশি বসে খুলে বসেন তাঁদের স্মৃতির ঝাঁপি। পঞ্চাশ বছর সংসার করার পরও কি দুজন দুজনকে চিনতে পারেন পুরোপুরি? নাকি তখনো বলার বাকি থাকে না বলা অনেক কথা?
মাত্র পৌনে দুই ঘণ্টার একটি ছোট্ট সিনেমা, ‘এই রাত তোমার আমার’। কিন্তু সিনেমাটি অনবদ্যভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরমব্রত। মাত্র একটি লোকেশনে, দুই-তিন রুমের ভেতরে দুটা মানুষের গোটা জীবন ফুটিয়ে তোলা মোটেও সহজ কথা নয়। আর এই কাজই অসাধারণভাবে করে দেখিয়েছেন এ নির্মাতা। খুব ছোট দৃশ্যগুলো এত সাবলীলভাবে পর্দায় ফুটে উঠেছে, দেখার পর অনেকক্ষণ মনে রয়ে যায়। মনে হয়, আমরা যেন যাপন করছি ওই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবন। কোমরব্যথা সারাতে স্প্রে দেওয়া, ভালোবেসে স্ত্রীর মুখ মুছিয়ে দেওয়া, এত বছর পর স্ত্রীর ভয় পাওয়ার দিকে খেয়াল রাখা—সবটাই খুব মায়াময়। অথচ ধাক্কা দেওয়ার মতো বাস্তবতায় মোড়া। আবার যখন দুজন মানুষ পাশাপাশি বসে অতীতের কথা রোমন্থন করছেন, তখন তাঁদের ছেলেমানুষিটা মন ভালো করে দেয়। অভিমানী কথাগুলো নাড়িয়ে দেয় ভেতরটাকে।
সিনেমাটি সংলাপনির্ভর না হলেও সংলাপপ্রধান। এখানে দুজন মানুষের জীবনের টুকরো গল্পগুলো উঠে আসে তাঁদের কথোপকথনে। দুই রুমের বাইরের কোনো ঘটনা দেখানো না হলেও দারুণ গল্প আর দুর্দান্ত অভিনয় একমুহূর্তও বিরক্ত হওয়ার অবকাশ দেয় না। দর্শকের কৌতূহল বজায় রাখতে এমনই একটি ঝকঝকে চিত্রনাট্য এবং সংলাপের প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্যভাবে।
‘এই রাত তোমার আমার’ সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন ও অঞ্জন দত্ত। বর্ষীয়ান এই দুই অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে তাঁদের দুজনকে পর্দায় মানিয়েছে খুব ভালো। বৃদ্ধ বয়সের নানা শারীরিক সমস্যা, সন্তানের প্রতি অভিমান, স্ত্রীকে যত্ন নেওয়া—স্বামীর চরিত্রে অঞ্জন অত্যন্ত ভালো অভিনয় করেছেন।
অপর্ণা সেনের উপস্থিতিটা এমন, যেন তিনি পর্দায় এলেই গল্প বলা হয়ে যায়। অসুস্থ হয়ে তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘সামলাতে পারবে তো একা একা? এই সংসার, ঘরদোর, ইঁদুর, কলকাতায় যাওয়া ছুটিতে, নিজেকে?’ এ যেন দায়িত্ব অর্পণ! শুধু এই একটি সংলাপে তিনি যেন দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন অমরকে। অপর্ণা সেনের ছেলেমানুষি কিংবা আবেগময় দৃশ্যগুলো বারবার বুঝিয়ে দেয়, পর্দায় দর্শকেরা দেখছেন একজন জাত অভিনেত্রীকে।
পার্শ্বচরিত্রে ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রুতি দাশ। পর্দায় তাঁদের উপস্থিতি কম সময়ের হলেও তাঁরা ভালো অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটি সংলাপনির্ভর না হলেও সংলাপপ্রধান। এখানে দুজন মানুষের জীবনের টুকরো গল্পগুলো উঠে আসে তাঁদের কথোপকথনে। দুই রুমের বাইরের কোনো ঘটনা দেখানো না হলেও দারুণ গল্প আর দুর্দান্ত অভিনয় একমুহূর্তও বিরক্ত হওয়ার অবকাশ দেয় না। দর্শকের কৌতূহল বজায় রাখতে এমনই একটি ঝকঝকে চিত্রনাট্য এবং সংলাপের প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্যভাবে। তার সঙ্গে আছে বুদ্ধিদীপ্ত সম্পাদনা (সুমিত চৌধুরী) এবং মসৃণ ক্যামেরার (প্রসেনজিৎ চৌধুরী) কাজ। দর্শকের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য আলো-আঁধারির এবং নানা ক্যামেরার লেন্সের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরারোপ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মোলায়েম। কখনোই কর্ণকণ্টকের কারণ নয়। আসলে পুরো ছবিটিই একটি পরিশীলিত নিচু তারে বাঁধা এবং সেই সুর কোথাও এতটুকু টাল খায় না। এটিই পরিচালকের মুনশিয়ানা। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা নিজেদের কাজটুকু মন দিয়ে করেছেন।
এমন সহকর্মী জড়ো করাটাই তো পরিচালকের তুখোড় প্রতিভার পরিচায়ক। সোমনাথ কুন্ডুর রূপসজ্জা, সাবর্ণী দাসের পোশাক পরিকল্পনা এবং হেমা মুন্সীর কেশসজ্জাও উচিত সংগত করেছে বাকি সব ক্ষেত্রের ভারসাম্যের সঙ্গে। ফলে পুরো কাজটিই প্রায় আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পেরেছে। উত্তর ইউরোপীয় ছবির কথা মনে করিয়ে দেয় ‘এই রাত তোমার আমার’। প্রতি পদে পরিশীলন এবং যত্নের ছাপ উজ্জ্বল করে রাখে এই সিনেমাদর্শনকে।
এর সিনেমাটোগ্রাফি এবং কালার গ্রেডিং চমৎকার। ঝড়ের রাত, বাজ পড়া, আলো-আঁধারের খেলা, সাউন্ড, ইঁদুরের দৌড়ানো—দৃশ্যগুলো যত্ন দিয়ে বানানো হয়েছে। তাই ছোট এ দৃশ্যগুলো অজান্তেই সিনেমার অংশ হয়ে উঠেছে।
দুটি মানুষের চরিত্রের নানা দিক একটু একটু করে বের হয়ে আসতে থাকে এ সিনেমাজুড়ে। আর এই জিনিস পুরো সিনেমায় মনোযোগ ধরে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বলা যায়, ছিমছাম গল্প আর দারুণ নির্মাণের জন্যই ‘এই রাত তোমার আমার’ মনে থাকবে বহুদিন।